বাগেরহাটে ‘সুখী মানুষ’ এনজিওর প্রতারনা : প্রকল্পের প্রায় ৩৬ কোটি টাকা ভেস্তের পথে

0
105


হানিফ শিকদার, বাগেরহাট
সারাদেশের ন্যায় বাগেরহাট জেলার ৮টি উপজেলায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় প্রায় ৩৬ কোটি টাকার আউট অব স্কুল এডুকেশন প্রোগ্রামের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাগেরহাটে ঝরে পড়া শিশুদের জন্য চালু করা হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। “সুখী মানুষ” নামক বেসরকারী সংস্থা বাগেরহাট জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য লিড এনজিও হিসেবে নির্বাচিত হয়। বাস্তবায়নের জন্য সুখী মানুষ এনজিও দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের চেষ্টায় লিপ্ত থাকার একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোজ নিয়ে জানা যায়, সুখী মানুষ সংস্থার বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট তথ্য গোপন করে সকল উপজেলায় বিধি বহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ, বৈধ শিক্ষার্থী জরিপ ব্যতীত শিক্ষক তালিকা তৈরী, ক্যাম্পেইন কমিটির সভাপতি প্রধান শিক্ষকের অনুমোদন ব্যতীত শিক্ষার্থীদের ভূয়া তালিকা প্রস্তুত করা, কর্মীদের বেতন ভাতা না দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, জামানতের নামে কর্মীদের নিকট থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায়, ব্যাংক জালিয়াতি, প্রকল্প কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে পার্টনার এনজিওদের সাথে অর্থের বিনিময়ে প্রতারণামূলক চুক্তি করাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে ‘সিটিজেন ভয়েস’ এর অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে বলে জানা গেছে। সরেজমিনে গিয়ে জানান যায়, প্রকল্পের সঠিক কোন নির্দেশনা কোন প্রতিষ্ঠানেই সঠিক ভাবে মানা হচ্ছে না। এখনো কোন ছাত্র ছাত্রীকে একটি ভাতার টাকাও দেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের বেতন, শিক্ষকদের বেতন, শিক্ষার্থী জরিপের জন্য প্রত্যেক কেন্ত্রে ১ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোন জরিপকারীকে তা পরিশোধ করে নাই। জেলার ৮টি উপজেলা কর্মকর্তা প্রত্যেকের নিকট থেকে জামানতের নামে অর্থ গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ সহ কেন্দ্রের শিক্ষকদের কাজ থেকে পিকনিকের কথা বলে বে-আইনী ভাবে টাকা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সদর উপজেলায় প্রায় ২ হাজার ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর তালিকা করার কথা হলেও বাস্তবের চিত্র ভিন্ন। তালিকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী আছেন যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রী। যা সম্পূর্ন বে-আইনী। তেমনি তালিকাতে যে সকল শিক্ষার্থীদের নাম আছে তার অধিকাংশ শিক্ষার্থীদেরই বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। সুখী মানুষ এনজিওর সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজারসহ সংস্থার বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সংস্থার এ অনৈতিক কাজে পূর্ববর্তী সহকারী পরিচালকগণ সহযোগিতা না করায় তাদের বদলী করে মুন্সীগঞ্জ জেলা থেকে হুমায়ুন সরদারকে সহকারী পরিচালক হিসেবে বাগেরহাট জেলায় অতিরিক্ত দায়িত্বে আনা হয়। জানা যায় এই কর্মকর্তা সুখী মানুষ সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্টজন। তারা বলেন, সুখী মানুষ সংস্থাটি ঊর্ধ্বত্বন কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের জন্য নামমাত্র কয়েকটি স্কুল স্থাপন করেছে। কর্মকর্তারা স্কুল পরিদর্শনের সময় শিক্ষিকারা আশপাশের বাড়ির স্কুল পড়–য়া ছেলেমেয়েদের জড়ো করে স্কুল পরিচালনা দেখায়। যা প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন। তবে শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রকল্প কর্মকর্তা হুমায়ুন সরদার ও সুখী মানুষ সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের নির্দেশনার বাইরে তাদের কিছু করনীয় নেই বলে জানান। এ দিকে সুখী মানুষ এনজিও ও বাগেরহাটের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রকল্প কর্মকর্তা হুমায়ুন সরদার বাগেরহাটে যোগদান করার সাথে সাথে সুখী মানুষ এনজিওর পূর্বের সকল অনিয়মকে বৈধতা দিয়ে অর্থ ছাড়করণে মরিয়া হয়ে উঠেন। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে সুখী মানুষ এনজিওর অর্থ ছাড় বন্ধ রাখার আদেশ থাকলেও গত জুন মাসে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আদেশ অমান্য করে হুমায়ুন কবির সরদার সুকৌশলে এজি অফিস থেকে বিপুল পরিমান অর্থ উঠিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসন বিষয়টি জানতে পেরে বিলটি অনুমোদন করেন নি। এবিষয়ে বাগেরহাট সদর উপজেলার এক রিপোর্টে জানা যায়, সদর উপজেলায় ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮৫৬ জন থাকলে প্রকৃত পক্ষে আছে মাত্র ৩৯ জন কিন্তু ১৮৫৬ জন শিক্ষার্থীর টাকা। একইভাবে ফকিরহাট উপজেলায় ১৭৭৭ জন, মোল্লাহাট উপজেলায় ২১০০ জন এবং চিতলমারী উপজেলায় ২৫২৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে দাবী করলেও সংস্থাটি বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব নাই। এ প্রকল্পের কর্মকর্তা হুমায়ুন সরদার যোগদান করার মাত্র ছয় কর্মদিবসের মধ্যে এবং ১৮ জুন’২২ তারিখে মাত্র এক দিনের পরিদর্শনে প্রায় তিনশত বিদ্যালয় এবং ৮২৬২ জন শিক্ষার্থী সব সঠিক আছে বলে ১৯ জুন-২২ তারিখে ৮৪ নম্বর পত্রে প্রতিবেদন দিয়েছেন। এ সময়কালে তিনি একই সাথে ৩টি জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তাই ১৮ জুন’২২ তারিখ পর্যন্ত বাগেরহাট জেলায় তার কর্মদিবস হয় মাত্র দুই দিন। বাগেরহাট সদর উপজেলা প্রোগ্রাম অফিসার মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, ২০২১ সালে আমার নিয়োগ হয় আজ পর্যন্ত কোন বেতন ভাতা পাই নাই। শিক্ষা কেন্দ্রের জন্য যে, সকল ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম তারা ঘরে তালা দিয়ে দিয়েছে। তাদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার শিক্ষকরা ও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এখন আমাদের চাকুরীচুত করার জন্য সহকারী পরিচালক ও সুখি মানুষের নির্বাহী পরিচালক উঠেপড়ে লেগেছে। এবিষয়ে শিক্ষক সুমি আক্তার জানান, এই প্রকল্পের শুরু থেকেই শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত আছি আজ পর্যন্ত আমাদের কোন বেতন দেয়নি কেন্দ্র পরিচালনার জন্য কোন ঘর ভাড়া দেয়নি বাড়ীর মালিক ঘরে তালা দিয়ে দিয়েছে বর্তমানে কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। ঘরের মালিকের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এবিষয়ে “সুখী মানুষ” এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক নাফিজা আফরোজ বর্নো বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা ও বানোয়াট। এক শ্রেনীর স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করতেই এ ধরনের কাজ করছে। তিনি বলেন,আমরা যা করছি তা সঠিক নিয়োম মেনেই কার্যক্রম পরিচালনা করছি। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক হুমাউন কবির সরদার বলেন, কয়েকটি কেন্দ্র বন্ধ আছে ঘরভাড়া না দেওয়ার কারনে ঘর মালিকেরা তালা দিয়ে দিয়েছে। আমি আমার নিজের পকেট থেকে কয়েক জন ঘর মালিকে ঘরভাড়া দিয়ে দিয়েছি। ঘরভাড়া না দেওয়ার বিষয়টা শুধু বাগেরহাটের না সারা বাংলাদেশের একই অবস্থা। মনিটরিং ভেরিভিকেশন রির্পোট গেলে তার পর অর্থ ছাড় হবে। ভেরিভিকেশন রিপোর্ট বিলম্বে হওয়ায় এসমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মোসাব্বেরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি আমাদের কাছে কিছু অনিয়মের অভিযোগ আসলে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আমারকাছে তদন্তের জন্য আসলে আমারা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সহায়তায় সদর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের মাধ্যমে তদন্ত করিয়েছি এবং শিক্ষার্থীদের তালিকা যাচাইবাছাই করে দেখেছি এসব কেন্দ্রে যতজন ঝরেপড়া শিক্ষাথী থাকার কথা তার চেয়ে অনেক কম রয়েছে। সুখী মানুষ আমাদের ১৮৫৬ জনের একটা তালিকা দিয়েছে। এর ভিতরে অনেক শিক্ষার্থী পাশ^বর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে বা তার পাশের একটি বিদ্যালয়ে পড়ে বা আফতেদায়ী মাদ্রাসায় পড়ে এখানে কিছু শিক্ষাথী ১৪ বছরের উপরে রয়েছে। আবার ৮ বছরের কম বয়েসের শিক্ষার্থী রয়েছে। দেখাগেছে বিশাল অংকের শিক্ষাথী এই প্রকল্পের আওতায় শিক্ষা গ্রহন করার উপযুক্ত নয়। ৩৯ জনের একটি তালিকা আমাদের প্রথমিক শিক্ষা দপ্তর থেকে পেয়েছি যারা এই প্রকল্পের উপযুক্ত শিক্ষার্থী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

Comment using Facebook