ফয়সাল আহমেদ, ঝিনাইদহ
ঝিনাইদহ পৌরসভায় চেক জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়েছে। মেয়রের চোখ ফাঁকি দিয়ে পৌরসভার একটি চক্র ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কাজের বিপরীতে ৮৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ঝিনাইদহ পৌর ভবনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনিয়মের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে তদন্ত করে জরুরী ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় ও পৌরসভার আভ্যন্তরীন অডিট রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১ জুন থেকে ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের বিপরীতে এই টাকা উত্তোলন করা হয়। ৩৭টি কাজের বিপরীতে ঝিনাইদহ সোনালী ব্যাংকের ৩১৬ নং একাউন্ট ও ঝিনাইদহ জনতা ব্যাংকের ১৪২৫০৩ নং একাউন্ট থেকে এই টাকা উত্তোলন করা হয়। তবে এই চেক জালিয়াতি নিয়ে পৌরসভার সাবেক সচিব আজমল হোসেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন, নির্বাহী পকৌশলী কামাল উদ্দীন ও হিসাব রক্ষক মখলেছুর রহমান একে অপরকে দোষারোপ করছেন।
এদিকে ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু চেক জালিয়াতির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ২০২১ সালের ২৭ জুন তাঁর দপ্তরের ২৯৬ নং স্মারকে প্রশাসনিক কমকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁনকে অন্যত্রে বদলি ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব (পৌর-১ শাখা) বরাবর চিঠি দেন। কারণ প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন একাই ১২টি কাজের বিপরীতে জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করেছেন ৩১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়েও তিনি নিজের নামে কাজ দেখিয়ে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকার স্থলে জালিয়াতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ২৮ লাখ টাকা লোপাট করেছেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয় আসাদুজ্জামান চাঁন স্টোর কিপার হিসেবে চাকরীতে যোগ দিয়ে পরবর্তীতে প্রধান সহকারী ও পদোন্নতি পেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। দীর্ঘ ২০ বছর তিনি একই কর্মস্থলে চাকরী করার কারণে প্রভাব বিস্তার করে নানা রকমের অনিয়ম ও পৌরসভার চেক নিজের নামে নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে চেকের পাতায় টাকার অংক বৃদ্ধি করে বিপুল পরিমান টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
চিঠিতে ঝিনাইদহ পৌরসভার স্বার্থ বিবেচনা করে আসাদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহন ও অন্যত্র বদলীর জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন পৌর মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু। পৌর মেয়রের চিঠি পাওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন ২০২১ সালের ১২ আগষ্ট তাঁর দপ্তরের ৪৬.০০. ০০০০. ০৬৩.২৭. ০০১.১৪.৬৭৮নং স্মারকে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালককে অভিযোগসমুহ সরেজমিন তদন্ত করে জরুরী ভিত্তিতে তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দশক্রমে অনুরোধ করেন।
উপসচিবের চিঠি আসার প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলেও জালিয়াতি চক্রের হোতারা অধরাই থেকে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা তো দুরের কথা বদলী পর্যন্ত হয়নি। বহাল তবিয়তে এই চক্রের নাটের গুরু আসাদুজ্জামান চাঁন চাকরী করে যাচ্ছেন বীরদর্পে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, সাবেক সচিব আজমল হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী কামাল উদ্দীন ও হিসাব রক্ষক মখলেছুর রহমানসহ অনেকেই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারা মেয়রের চোখ ফাঁকি দিয়ে চেক বইয়ের সামনের কিছু অংশ ফাঁকা রেখে পরবর্তীতে টাকার অংক বসিয়ে নিতেন। এ ভাবে বছরের পর বছর জালিয়াতি চক্রটি ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৬ টাকা কাজের বিপরীতে ৮৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬৯৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। তারা জালিয়াতির মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮২ টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
পৌরসভার হিসাব বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সাইদুল করিম মিন্টু মেয়র হওয়ার ৫ বছর পর্যন্ত নাটের গুরু আসাদুজ্জামান চাঁন হাট বাজারের আয়কর ও ব্যাটের টাকা জমা দেননি। এই টাকা তিনি পকেটস্থ করেছেন, যা নথী তলব করলে প্রমান পাওয়া যাবে। এদিকে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১ জুন তারিখে পৌরসভার ক্যাশ বইতে জনৈক নওশের আলীর নামে ১০ হাজার টাকা লিপিবদ্ধ আছে। অথচ ১০ হাজার টাকার স্থলে সোনালী ব্যাংকের ৩১৬ নং একাউন্ট থেকে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
জালিয়াতির মাধ্যমে চার লাখ টাকা বেশি উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। নওশের ছাড়াও যাদের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে তারা হলেন, প্রসাশনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চান, নির্বাহী প্রকৌশলী কামাল উদ্দীন, স্যানেটারি ইন্সপেক্টর শংকর নন্দী, প্রকৌশলী মুন্সি আবু জাফর, হিসাব রক্ষক মখলেছুর রহমান, দেলোয়ার হোসেন, সাইদুর রহমান, কনজারভেন্সি পরিদর্শক সামছুল আলম, কমিশনার তোফাজ্জেল হোসেন, পানি বিভাগের বিল ক্লার্ক আনোয়ার হোসেন, কমিশনার মতলেব মিয়া, সাহিনা মৌসুমি, কমিশনার সাইফুল ইসলাম মধু, মিঠু ইলেক্ট্রনিক, কমিশনার বশির উদ্দীন ও রবিউল ইসলাম।
এব্যাপারে অভিযুক্ত প্রশাসিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন বলেন, চেক জালিয়াতি তো আমি করতে পারি না। এটি একাউন্ট কর্মকর্তা মকলেছুর রহমান করতে পারেন। একাউন্ট কর্মকর্তা মকলেচুর রহমান বলেন, সাবেক সচিব আজমল হোসেন, প্রশাসিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন, প্রকৌশলী কামাল উদ্দীন আমাকে দিয়ে জালিয়াতি করাতে বাধ্য করেছেন। তাদের কাছে আমি অসহায় ছিলাম।
প্রকৌশলী কামাল হোসেন সব ঘটনা অস্বীকার করে বলেন, আমি কিছুই জানি না। সাবেক সচিব আজমলের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মুঠোফোনটি ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ বাপারে ঝিনাইদহ পৌরসভার বর্তমান প্রশাসক ও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক দপ্তরের উপ-পরিচালক ডিডিএলজি মোঃ ইয়ারুল ইসলাম বলেন, যেহেতু জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তের স্বার্থে এখন কোন বক্তব্য দিতে পারছি না।