যশোর অফিস
যশোরের বাঘারপাড়ায় অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নাম মাত্র কাজ করিয়ে শ্রমিকদের সমুদয় টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। শ্রমিকদের মোবাইল একাউন্টের সিম কার্ডটিও জনপ্রতিনিধিদের কবজায়। এমনকি সিম কার্ডে আসা মুজুরির টাকা উত্তোলন করেন স্থানীয় মেম্বর বা চেয়ারম্যানরা। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাঘারপাড়া উপজেলায় অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে (দ্বিতীয় পর্যায়) ২৭টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১ কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে কর্মসূচির কাজ গত ২৯ এপ্রিল শুরু হয়ে ৩০ জুন শেষ হয়। এজন্য উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৭৬ জন শ্রমিক নির্বাচন করা হয়। প্রতিটি প্রকল্পে সর্বোচ্চ ৪০ দিন কাজ করা যাবে। উপজেলায় অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) ২৭টি প্রকল্পে ২৩ দিন কাজ হয়েছে। কিন্তু উপজেলার দোহাকুলা ইউনিয়নের একজন শ্রমিক মাত্র নয় দিন কাজ করেছেন। তাঁর মোবাইল অ্যাকাউন্টে মজুরির টাকা এসেছে। তবে তিনি টাকা তোলেননি। কারণ মোবাইল অ্যাকাউন্টের সিম তাঁর কাছে নেই। সিম রয়েছে ইউপি সদস্যের কাছে। তিনি টাকা তুলে ওই শ্রমিককে দিয়েছেন। ই্উনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ওই শ্রমিক বলেন, ‘দোহাকুলা ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে আমরা সব শ্রমিক একসাথে মোবাইল সিম কিনেছিলাম। এরপর জসিম মেম্বার আমার কাছ থেকে সিম নিয়ে নেন। বর্তমানে সিম তাঁর কাছে আছে। এইবার আমি নয় দিন কাজ করেছি। জসিম মেম্বার আমার সিম দিয়ে টাকা তুলে আমাকে ৩৫০০ টাকা দিয়েছে।’ জানতে চাইলে ইউপি সদস্য জসিম উদ্দীন বলেন, ‘আমি কোনো প্রকল্পের সভাপতি না। আমাকে পরিষদ থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে, সেই টাকা আমি আমার ওয়ার্ডের শ্রমিকদের দিয়েছি। সিম কার কাছে থাকে আমি জানি না, সিম ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব আমার না।’ ওই শ্রমিকের মতো বাঘারপাড়া উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে অতি দরিদ্র শ্রমিকদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির শ্রমিকদের মজুরির টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বেশিদিন কাজ দেখিয়ে উত্তোলন করা টাকা থেকে শ্রমিকদের কিছু টাকা দিয়ে অবশিষ্ট টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী মজুরি পরিশোধের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে মিল রেখে প্রত্যেক শ্রমিকের নিজস্ব মোবাইল অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। একজন শ্রমিক দিনে ৪০০ টাকা পাবেন এবং জবকার্ডে তা উল্লেখ করতে হবে। প্রকল্পের কাজের তদারকি করবেন সংশ্লিষ্ট ট্যাগ অফিসার (তদারকি কর্মকর্তা) ২৫ শতাংশ, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ৪০ শতাংশ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ১০ শতাংশ, জেলা ত্রাণ দুর্যোগ ও পুণবাসন কর্মকর্তা ১০ শতাংশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ১০ শতাংশ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের কর্মসূচি প্রশাসন শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী শতভাগ কাজ তদারকি করবেন। নিয়মানুযায়ী, প্রকল্পের সভাপতি মাস্টার রোল তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর করবেন। এরপর তদারকি কর্মকর্তা, প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার স্বাক্ষর নিয়ে তা অনলাইনে হিসাবে জমা দেবেন। পরে শ্রমিকেরা মোবাইল অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁদের টাকা উত্তোলন করবেন। সূত্র জানায়, বাঘারপাড়া উপজেলায় অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে (দ্বিতীয় পর্যায়) ২৩ দিন কাজ করা হয়। শ্রমিকেরা অভিযোগ করেছেন, মোবাইল অ্যাকাউন্ট তাঁদের নামে। কর্মসূচির মজুরির টাকা তাঁদের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশের কাছে মজুরির টাকা উঠানোর মোবাইল অ্যাকাউন্ট সিম নেই। কাজ শুরুর আগে বেশিরভাগ শ্রমিকের মোবাইল অ্যাকাউন্ট সিম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যরা নিয়ে গেছেন। ওই সিম দিয়ে অ্যাকাউন্ট থেকে মজুরির টাকা তুলে ইউপি সদস্যরা তাঁদের দিয়েছেন। উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে ঘুরে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার কোনো ইউনিয়নে ২৩ দিন কাজ হয়নি। কোনো ইউনিয়নে আট দিন, কোনো ইউনিয়নে নয় দিন, কোনো ইউনিয়নে ১০ দিন আবার কোনো ইউনিয়নে ১৬ দিন কাজ হয়েছে। বন্দবিলা ইউনিয়নের একজন নারী শ্রমিক জানান, আমি এইবার ১০ দিন কাজ করেছি। চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে জিকু খান নামে একজন আমার মোবাইল সিম নিয়ে নিয়েছে। তিনি আমার সিম দিয়ে টাকা তুলে আমাকে ৩ হাজার ২০০ টাকা দিয়েছেন। জানতে চাইলে জিকু খান বলেন, ‘ইউনিয়নে ১৪৪ জন শ্রমিক আছে। যে শ্রমিক যে কয়দিন কাজ করেছে তাঁকে সেইভাবে টাকা দেওয়া হয়েছে। যার যার সিম তার তার কাছে আছে। আমার কাছে বর্তমান ৮-১০ টি সিম আছে।’ রায়পুর ইউনিয়নের একজন শ্রমিক বলেন, আমি রাস্তায় নয় দিন কাজ করিছি। পলাশ মেম্বার আমার সিম দিয়ে টাকা তুলে আমাকে আট দিনের মজুরি ৩ হাজার ২০০ টাকা দিয়েছেন। তিনি আমাকে সিম ফেরত দেননি। ই্উনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সদস্য এসএম সাইফুল ইসলাম পলাশ বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে আট-নয় জন শ্রমিক কাজ করে। আমি তাদের টাকা দিয়েছি।’ টাকা তিনি কীভাবে তুললেন জানতে চাইতে তিনি বলেন, ‘টাকা মানে সিম আমি তাঁদের দিয়েছি। আমার কাছে সিম নেই, সিম তাঁদের কাছে আছে।’ বাসুয়াড়ি ইউনিয়নের একজন শ্রমিক জানান, আমারা ১৬ জন শ্রমিক নয় দিন কাজ করেছি। ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শিমুল হোসেন আমাকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা দিয়েছেন। সিম কার কাছে আছে, আমি জানি না। ইউপি সদস্য শিমুল হোসেন বলেন, ‘শ্রমিকেরা মোবাইল থেকে টাকা তুলতে পারতেন না। এজন্য চেয়ারম্যানের অনুরোধে আমি প্রথম পর্যায়ের টাকা তুলে দিয়েছিলাম। দ্বিতীয় পর্যায়ের টাকা চেয়ারম্যান তুলে দিয়েছেন।’ বাসুয়াড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান সরদার বলেন, ‘ঈদের সময় আমি নিজের টাকা থেকে শ্রমিকদের টাকা দিয়েছিলাম। পরে সেই টাকা আমি তুলে নিয়েছি। যার সিম তার কাছেই আছে।’ দরাজহাট ইউনিয়নের একজন শ্রমিক জানান, আমাদের প্রকল্পে আমরা প্রতিদিন ১২-১৩ জন করে ১৬ দিন কাজ করেছি। শামসুর মেম্বার আমাকে ৬ হাজার ৪০০ টাকা দিয়েছেন। সিম মেম্বারের কাছে আছে। ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শামসুর রহমান বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের শ্রমিকেরা আমারে খুব বিশ্বাস করেন, তাঁরা এ কথা আমার বিরুদ্ধে কোনোদিন বলতেই পারে না।’ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘উপজেলায় ২৩দিন কাজ হয়েছে। শ্রমিকেরা মজুরির টাকা মোবাইল অ্যাকাউন্টে পেয়েছেন। কাজ কম এবং মজুরি কম পাওয়ার বিষয়টি আমার নলেজে আসেনি। বিষয়টি খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ জাকির হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করা হবে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাঘারপাড়ায় অতি দরিদ্রদের কর্মসূচি প্রকল্পে বিস্তর অনিয়ম!
Comment using Facebook