কপোতাক্ষের ভয়াবহ ভাঙ্গনে হুমকির মুখে বিস্তীর্ণ জনপদ

0
103


পাইকগাছা সংবাদদাতা
খুলনার পাইকগাছায় কপোতাক্ষ নদের ভয়াবহ ভাঙ্গনে নতুন করে হুমকির মুখে বিস্তীর্ণ জনপদ। আগ্রাসী কপোতাক্ষের ভাঙ্গন ও পরে নাব্যতা হ্রাসে নদের তীরে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর পড়ে বিরূপ প্রভাব। ভিটা-বাড়ি হারিয়ে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। জীবিকার তাগিদে পেশা বদলও ঘটেছে অনেকের। এরপর গণদাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২৬২ কোটি টাকা ব্যায়ে কপোতাক্ষ খনন করে। নদের একাংশ ফিরে পায় তার হারানো যৌবন। তবে কপোতাক্ষের ফের ভাঙ্গনে নতুন করে উদ্বাস্তু হচ্ছে নদের তীরে বসবাসকারী বহু পরিবার। হুমকির মুখে পড়েছে সরকারের বহু উন্নয়ন প্রকল্প। চরম ঝুঁকিতে রয়েছে মুজিব শতবর্ষে গৃহহীন ও ভূমিহীন বহু পরিবারের পূণর্বাসনে গড়া আবাসন প্রকল্পসহ হাট-বাজার, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের কাশিমনগর হাট-বাজার, মসজিদ, দোকান-পাঠ ও ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা ব্যায়ে দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন (সিআরএমআই ডিপি) প্রকল্পের নির্মাণাধীন চার তলা ফাউন্ডেশন কাশিমনগর হাট, দুই তলা বিশিষ্ট গ্রামীণ মার্কেট বিল্ডিং, মুজিব শতবর্ষের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের আবাসন প্রকল্প চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। কপোতাক্ষ পাড়ের বনায়ন প্রকল্পের সিংহভাগ গাছ ইতোমধ্যে গিলে খেয়েছে আগ্রাসী কপোতাক্ষ। রামনাথপুরের বহু ঘর বাড়ি, এতিমখানা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কয়েক শত একর জমি কপোতাক্ষ নদে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে কপিলমুনির নতুন মাছকাটা থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী কপিলেশ্বরী কালীবাড়ী ঘাট, হাট-বাজার, কাশিমনগর জেলেপাড়া, গোলাবাটিসহ রাড়-লী ইউনিয়নে কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গন ফের ব্যাপক আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে সেখানকার জেলেপল্লীর অন্তত ৭০ পরিবার ভাঙ্গনের মুখে অন্যত্র চলে গেছে। নদীগর্ভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে আরো ২০ পরিবারের বসতভিটা। নদেরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সেখানকার চলাচলের একমাত্র রাস্তার দুই তৃতীয়াংশ। জোয়ারের পানি ঠেকানোর জন্যও সেখানে নেই কোনো বাঁধ। ফলে প্রতি অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় জোয়ারে পানি বাড়লে এলাকায় লবণ পানিতে প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা, ফসলি জমি ও কাঁচা-পাকা ঘর-বাড়ি। এ ছাড়া ভয়াবহ ভাঙ্গন শুরু হয়েছে বোয়ালিয়া জেলে পাড়া, রামনাথপুরসহ কপোতাক্ষের বিভিন্ন এলাকা। কাশিমনগর জেলেপল্লীর বাসিন্দা উত্তম বিশ্বাস জানান, একশ বছরেরও বেশী সময় ধরে তারা সেখানে বসবাস করে আসছেন। তাদেরসহ বহু পরিবারের মূল বসত-ভিটা গিলে খেয়েছে আগ্রাসী কপোতাক্ষ। অনেকেই পেশা বদলে অন্যত্র চলে গেছে। উদ্বাস্তু হয়েছে অনেক পরিবার। তার নিজেরও দু’বার বসতি বদল হয়েছে। রাড়-লীর জেলেপল্লীর বাসিন্দা ভূধর বিশ্বাস বলেন, আমার বাবা ও দাদুরা প্রায় ১শ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছেন। নদীর কূলে ১শ থেকে দেড়শ বিঘা জমি ছিলো। যেখানে দেড়শ’রও বেশি পরিবারের বসতি ছিলো। তবে নদের অব্যাহত ভাঙ্গনের মুখে সেখানকার ৭০ টিরও বেশি পরিবারের ঘর কেড়ে নিয়েছে কপোতাক্ষ নদ। একই এলাকার লিপিকা বিশ্বাস জানান, রাতে জোয়ারের সময় ভয়ে বাচ্চাদের নিয়ে বসে থাকেন ভাটার অপেক্ষায়। এরপর ভাঁটা আসলে ঘুমাতে যান তারা। রাড়-লীর ৩নং ওয়ার্ডের ফরিদা বেগম (৫৫) বলেন, তাদের এখনকার বাড়ি ছাড়া নদীর অবস্থান ছিল প্রায় আঁধা কিলোমিটার দূরে। জেলেপল্লীর পরে ছিলো তাদের বসবাস। তারা ছাড়াও প্রায় ৪০ পরিবাবারের বসবাস ছিল সেখানে। তবে কপোতাক্ষের ক্রমশ আগ্রাসন জেলেপল্লীর পর এখন তাদেরকেও নদের কিনারায় নিয়ে ঠেঁকিয়েছে। যেকোন সময় তাদের ঘর টুকুও নিমজ্জিত হতে পারে ভাঙ্গনে। একই এলাকার বারিক মোড়ল বলেন, ভাঙ্গনের মুখে তিনি অন্তত তিনবার ঘর পরিবর্তন করেছেন। তার পরেও রান্না ও কাঠের ঘর টুকুও নদে চলে গেছে। বাকি ঘরখানিও যেকোন সময় চলে যেতে পারে নদী গর্ভে। সঙ্গতি না থাকায় অন্যত্র জমি কিনে বসবাসেরও উপায় নেই অন্যদিকে সরকারও নদ ভাঙ্গন রোধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। রাড়-লীর বাসিন্দা প্রভাষক ময়েজুর রহমান জানান, রাড়-লী ইউনিয়নের প্রবেশদ্বারের পুরাতন ওয়াপদা রস্তÍায় নতুন করে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে সেখান থেকে নদের পানি প্রবেশ করছে। তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের পরামর্শে স্বেচ্ছাশ্রমে স্থানীয়দের সাথে নিয়ে বাঁধটি আশু মেরামত করেছেন। তিনি আরো বলেন, এর আগে বাঁধটি ২০০৯ সালে আইলায় ভেঙ্গে ব্যাপক ক্ষগ্রিস্ত হয়। কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দার বলেন, রামনাথপুর, আগড়ঘাটা, ভেদামারীসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে কপোতাক্ষ নদের ভয়াবহ ভাঙ্গনে সেখানকার বসতিসহ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ফসলি জমি নদেরগর্ভে বিলীন হলেও সেখানকার নদ ভাঙ্গন প্রতিরোধে কার্যত কোনো সরকার এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিভিন্ন সময় এলাকাবাসীর অর্থায়ণ ও স্বেচ্ছাশ্রমে তারা যতটুকু সম্ভব কাজ করেছেন। কাশিমনগর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইউপি সদস্য শেখ রবিউল ইসলাম বলেন, কপোতাক্ষের ভয়াবহ ভাঙ্গনে নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বনায়ন প্রকল্প, হাট-বাজারের সিংহ ভাগ ইতোমধ্যে কপোতাক্ষে বিলীন হয়েছে। নতুন করে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে স্থানীয় আশ্রয়ণ প্রকল্প, মসজিদ, শ্মশানঘাট, নির্মাণাধীন গ্রামীণ মার্কেটসহ নদী তীরের বহু বসতবাড়ি। সর্বশেষ পাউবোর অর্থায়ণে নির্মাণাধীন মার্কেটের পেছনে ১২০ মিটার এলাকায় জিআই ব্যাগ দিয়ে বাঁধ দেওয়া হলেও বাকি এলাকায় ভাঙ্গনের প্রসারতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাইকগাছা উপজেলা উপ-সহকরী প্রকৌশলী রাজু আহম্মদ বলেন, ভাঙ্গন প্রতিরোধে জরুরী ভিত্তিতে প্রকল্প আওতায় নিয়ে ইতোমধ্যে কপোতাক্ষের ভাঙ্গনকবলিত কাশিমনগর এলাকায় ২০০মিটার, গোলাবাটি আশ্রয়ণ এলাকায় ৩০০মিটার ও মাহমুদকাটিতে সাড়ে ৩শ মিটার এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

Comment using Facebook