যশোরে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে তোষক কান্ড

0
250

সাকিরুল কবির রিটন, যশোর

যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আসবাবপত্র কেনার জন্য সরকারী বরাদ্দের ১৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। আর সরকারী বরাদ্দের এই বিপুল পরিমান টাকা নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে যশোরের সাবেক মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সোখিনা বেগমের বিরুদ্ধে।

বিশেষ করে যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের তোষক কান্ড রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশ কান্ড ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পর্দাকান্ডকেও হার মানিয়েছে।

সোখিনা বেগম একটি সিঙ্গেল তোষকের ক্রয় মুল্য দেখিয়েছেন ৩ হাজার ৩শ’ টাকা। যা যশোরের স্থানীয় বাজারে সর্বোচ্চ ৩শ’ টাকা মুল্যে বিক্রি হচেছ হরহামেশায়।

এছাড়া টিভি, ফ্রিজ, খাট, আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল, স্টিলের ফাইল কেবিনেট, পড়ার টেবিল, কম্পিউটার ও কম্পিউটার টেবিল, ফটোকপিয়ার মেশিন, স্ক্যানার মেশিন, ফ্যাক্স মেশিনসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ক্রয়ে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সাবেক এই উপ পরিচালকের বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, যশোর সরকারী কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আসবাবপত্র ক্রয় করার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়মন্ত্রণালয় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকার বরাদ্দ দেয়। আর এই বরাদ্দ আসে যশোর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে। কিন্তু বিপুল পরিমান এই অর্থে নামমাত্র কেনাকাটা করে বাকী টাকাটাই তসরুপ করার অবিযোগ উঠেছে যশোর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক সোখিনা বেগমের বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারী বরাদ্দের টাকায় মালামাল ক্রয়ের জন্য কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের একটি ক্রয় কমিটি আছে। কিন্তু এই ক্রয় কমিটিকে বাইপাস করে নিজেই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের প্যাডে কোটেশানের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার মালামাল একাই ক্রয় করেছেন সাবেক এই উপ পরিচালক। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, যশোর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক সোখিনা বেগম ২০টি সিঙ্গেল তোষকের ক্রয় মূল্য দেখান ৬৬ হাজার টাকা। যার প্রতিটির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩ হাজার ৩০০ টাকায়।

অথচ যশোরের স্থানীয় বাজারে প্রতিটি সিঙ্গেল তোষকের মূল্য ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অথচ সোখিনা বেগম নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিজেই এ দাম নির্ধারণ করেন। ২৬টি সিঙ্গেল চৌকি খাট ক্রয় করা হয়েছে। যার মোট মুল্য দেখানো হয়েছে ৩ লক্ষ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। প্রতিটি সিঙ্গেল চৗকি খাটের মূল্য দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৮০০ টাকা। অথচ প্রতিটি খাটের স্থানীয় বাজার মূল্য ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা।

দুইটি ছোট স্টিল আলমারির মূল্য ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার টাকা। অথচ স্থানী বাজারে এ আলমারি দুটির দাম ১৪ হাজার টাকার বেশি না। একটি ছোট স্টীল ফাইল কেবিনেট (৪ ড্রয়ারের) দাম দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৯৫০ টাকা। এ ধরনের স্টিল ফাইল ক্যাবিনেটের যশোরের বাজার মূল্য সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা। ২লাখ ৪ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে ১২টি ডেসিং টেবিল। যার প্রতিটির ক্রয় মূল্য পড়েছে ১৭ হাজার টাকা।

যশোরের বাজারে এ ধরনের ড্রেসিং টেবিলের দাম সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে। দুইটি ডাইনিং টেবিলের ক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। যার প্রতিটির মূল্য ধরা করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা করে। স্থানীয় বাজারে এধরনের ডাইনিং টেবিলের দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মধ্যে।

হাতলযুক্ত সাধারণ একটি সোফা সেটের মুল্য দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার পাঁচশ টাকা। যার প্রকৃত বাজার মূল্য ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ৬৪টি পণ্যের মূল্য দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার ২৫০ টাকা। ৭ শতাংশ ভ্যাটসহ দাম দেখানো হয়েছে ৮ লাখ ২৪ হাজার ১৬৭ টাকা। একটি ৫৬ সিএফটি সার্ফ ডীপ ফ্রিজের মূল্য দেখানো হয়েছে এক লাখ টাকা, প্রকৃতপক্ষে এটির বাজার মূল্য ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। একটি ফটোকপিয়ার মেশিনের দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যার প্রকৃত বাজার মূল্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা, একটি চায়না নন ব্র্যান্ডের ৫৬ ইি টেলিভিশনের দাম ধরা হয়েছে এক লাখ টাকা।

যার প্রকৃত বাজার মূল্য ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। একটি ডেক্সটপ কম্পিউটারের মূল্য দেখানো হয়েছে ৮০ হাজার টাকা, যার প্রকৃত বাজার মূল্য ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকা। একটি ক্যানন ব্র্যান্ডের প্রিন্টারের দাম ধরা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। একটি স্ক্যানার মেশিনের মূল্য ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা, যার কোন অস্তিত্ব নেই। একটা ফ্যাক্স মেশিনের মূল্য দেখানো হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু অফিসে গিয়ে কোন ফ্যাক্স মেশিন পাওয়া যায় নি। এই সাতটি পণ্যের মোট দাম ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যা বর্তমান বাজার মূল্যের দ্বিগুনেরও বেশি।

এছাড়া অবশিষ্ট ৪ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৩ টাকায় ক্রয় দেখানো হয়েছে ১২ টি স্টিলের আলনা, একটি কম্পিউটার টেবিল, একটি চেয়ার, হাতলযুক্ত দশটি গদিওয়ালা চেয়ার, দুইটি জুনিয়র এক্সিকিউটিভ টেবিল, একটি এক্সিকিউটিভ টেবিল, একটি মিটসেফ, হাতলযুক্ত কাঠের চেয়ার তিনটি, রিডিং টেবিল ৩৬ টি ও ২৬টি সাধারণ চেয়ার। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সোখিনা বেগম যশোর মহিলা অধিদপ্তরে দায়িত্ব থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দেওয়া টাকা পয়সা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিজেই তসররুপ করেছেন। এরমধ্যে যশোরে কিশোর ক্লাবে জন্য দেওয়া টিফিনের টাকা ও বিভিন্ন অনুদানের টাকা নিজে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নারীদের মাতৃকালীন অনুদানের টাকাও এ কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছেন বলে একাধিক নারী অভিযোগ করেছেন। আত্মসাৎ করা এই বিপুল পরিমান টাকা দিয়ে তিনি যশোর মেডিকেল কলেজের সামনে মেইন রোডের সাথে (শংকরপুর মৌজায়) নুরুদ্দিন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৮ শতক জমি ক্রয় করেছেন। ওই জমির উপরে ৫ তলা ফাউন্ডেশান দিয়ে তিনি তিন তলা আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। বর্তমানে চতুর্থ তলার নির্মান কাজ চলমান ।

প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য এই বাড়ি তৈরীর টাকা তিনি কোথায় পেলেন তা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে রয়েছে নানা গুঞ্জন। এলাকাবাসী বলছেন, সোখিনা বেগমের স্বামীও তেমন কিছুই করেন না, সারাদিন ঘরের ভিতরে আবদ্ধ থাকেন। অনেকটা গৃহস্বামীর মতোই। তার স্বামীর চেহারা এলাকার কেউ তেমন দেখেননি বলে জানান। তাদের এই বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে অনেকের মধ্যেই কৌতূহল শুরু হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার এক প্রতিবেশী জানান, একটা মানুষ চাকরি করে শহরে ভাড়া বাড়ি থেকে ৫/৬ বছরে কত টাকায় বা জমাতে পারে যে, তিন বছরের মধ্যে কোটি টাকার জমি ক্রয় করে আবার সেই জমির উপরে ২ কোটি টাকার বেশি খরচ করে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করা যায়।

অনৈতিকভাবে উপার্জন করা টাকা ছাড়া এমন বাড়ি তৈরি করা সম্ভব নয় বলেও তিনি জানান। যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের অফিস সহকারি নাসরিন আক্তার মালার কাছে এই মালামাল ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যশোরে কর্মজীবী মহিলাদের আবাসন সুবিধার্থে শহরের ভোলা ট্যাংক রোডে এই হোস্টেলটি অবস্থিত। এই হোস্টেলে মালামাল কেনাকাটার জন্য সরকার বিপুল পরিমাণে টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলে শুনেছি। মহিলা বিষয় অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোখিনা বেগম সরকারের নিয়ম নীতির কোন তোয়ক্কা না করে নামসর্বস্ব মালামাল ক্রয় করে হোস্টেলে সরবরাহ করেছেন। তিনি আরো জানান, আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য একটি কমিটি থাকলেও সোখিনা বেগম কমিটির কারোর কোন মূল্যায়ন না করে তিনি নিজের ইচ্ছামত নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের প্যাডে বিল ভাউচার করে মালামালগুলো সরবরাহ করেছেন। মালামালগুলো গ্রহণ করা হয়েছে এই মর্মে তিনি হোস্টেল সুপারের কাছ থেকে অনেকটা জোর করেই লিখিত নিয়েছেন বলে দাবি করেন নাসরিন আক্তার মালা।

এছাড়া এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, এসব পণ্যের ভুতুড়ে বিল ভাউচার দেখে তিনি নিজেই অবাক হয়েছেন। জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক ডিডি নিম্নমানের কিছু মালামাল দিয়ে উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করেছেন বলেও তিনি দাবি করেন।

বিষয়টি তিনি বর্তমানে দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক আনিসুর রহমানকেও জানিয়েছেন। বর্তমান ডিডি ইতিমধ্যে হোস্টেল পরিদর্শন করেছেন এবং বিষয়টি সম্পর্কে আরো অধিক খোঁজ খবর নিয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলে জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে যশোর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক সোখিনা বেগমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বারবার ফোনটা রিসিভ করে ব্যস্ততার অজুহাতে কেটে দেন।

বিষয়টি নিয়ে যশোর মহিলা বিষয় অধিদপ্তরের বর্তমানে দায়িত্বে থাকা উপ-পরিচালক আনিসুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখানে এসেছি গত দুমাস হল। আসার পর পর বিষয়টি জেনেছি। জানার পরে সাবেক মহিলা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোখিনা বেগমকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

তিনি লিখিতভাবে জানিয়েছেন কেনাকাটার বিষয়টি বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। তাই আমার সব মনে নেই। সোখিনা ম্যাডামের এ ধরনের বক্তব্য আমি নোট করেছি।

উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হবে বলে তিনি জানান। বিষয়টি নিয়ে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মনোয়ারা ইশরাতের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের জন্য আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল কেনাকাটার জন্য টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল গত অর্থ বছরে। সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় বিল ভাউচার দাখিল করেছেন।

কিন্তু কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। তাছাড়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের বিষয়টি দেখাশোনা করে থাকেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অতিরিক্ত পরিচালক) মুসলিমা খাতুন মুন। বিষয়টি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন এ কর্মকর্তা।

বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অতিরিক্ত পরিচালক) মুসলিমা খাতুন মুনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ আমার জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

Comment using Facebook