আ: লতিফ মোড়ল, ডুমুরিয়া (খুলনা)
নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই খুলনার ডুমুরিয়ায় চটচটিয়া-শিবনগর ব্রীজের একটি অংশ দেবে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্রীজটি নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণের মান নিয়েও অভিযোগ রয়েছে।
ফলে ব্রীজটির স্থায়ীত্ব নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদিকে ত্রুটিপূর্ণ ব্রীজটি তড়িঘড়ি করে হস্তান্তর ও খুলে দিতে তোড় জোড় শুরু হয়েছে। ত্রুটির বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ম্যানেজ মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও এলজিইডির প্রকৌশলীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, খুলনার শহর হতে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ডুমুরিয়া-পাইকগাছা-কয়রা এবং সাতক্ষীরার তালা উপজেলা এলাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সহজ করতে ডুমুরিয়ায় চটচটিয়া-শিবনগর সড়কে পিসি গার্ডার ব্রীজ নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ব্রীজটি নির্মাণে প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয় ৩১ কোটি ৩১ লাখ ৪১ হাজার ১৭০ টাকা। তবে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২৭ কোটি ৯৭ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৪ টাকা ১২ পয়সা মূল্যে ২০১৭ সালে যশোরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএমবি-আইটি (জেভি)-এর সাথে চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়। এরপর ওই বছর ১২ নভেম্বর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন কাজ শুরু করে। যার কাজ সমাপ্তির মেয়াদ ধরা হয় ২০১৯ সালের ১১ মে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি। ফলে মেয়াদ বেড়েছে চলতি বছর জুন মাস পর্যন্ত। আর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত সাড়ে ২৮ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়নের বসুন্দিয়াডাঙ্গা বাজার-মাগুরখালী ইউপি অফিস সড়কে ২ হাজার ৪৯০ মিটার চেইনেজে ভদ্রা নদীর উপর ৩১৫ দশমিক ৩০ মিটার লম্বা ও ৭ দশমিক ৩ মিটার চওড়া পিসি গার্ডার ব্রীজ নির্মিত হচ্ছে। যেখানে ৪৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৭টি স্প্যান বসেছে।
এছাড়া দু’পাশে ৩০০ মিটার করে এ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকী কাজ শেষে চলতি বছর মার্চে ব্রীজটি হস্তান্তর করা হবে। স্থানীয় বাসিন্দা কমলেশ মন্ডল, সাধন মহন্ত, আশরাফ হোসেন মোল্যা কৃষ্ণপদ মন্ডল ও অসীম মন্ডল জানান, ব্রীজের চরচরিয়া অংশের দ্বিতীয় স্প্যানটি দেবে গেছে। এর কারণে স্প্যানের উপরের অংশের ব্রীজ নিচু হয়েছে। মালামাল নিয়ে মাঝারী বা বড় ধরনের ট্রাক এবং যানবাহন চলাচলে ওই স্থানটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া ব্রীজটি নির্মাণেও নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে একাধিক কোম্পানির রড ব্যবহৃত হয়েছে। সব রডে এখনই মরিচা চলে এসেছে। এতে ব্রীজটির স্থায়ীত্ব তাড়াতাড়িই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাইকগাছার বাসিন্দা দেবাশীষ রায়, যিনি প্রতিনিয়তই ওই সড়ক ব্যবহার করে খুলনায় আসেন।
তিনি জানান, ব্রীজটি নির্মাণে পাইকগাছার সাথে খুলনার দূরত্ব অন্তত ২০ কিলোমিটার কমবে। সময় বাঁচবে দেড় ঘন্টা। এছাড়া ব্রীজটি ব্যবহার করে মৎস্য ও কৃষি পণ্য সহজে বাজারজাত করা সম্ভব হবে। ফলে ব্রীজটি নির্মাণে এ অঞ্চলের মানুষ বিশেষ ভাবে উপকৃত হবে। কিন্তু নির্মাণের মান সন্তোষজনক হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, ব্রীজের দিকে তাকালে যে কেউই সহজে বুঝবে চটচটিয়া অংশের দ্বিতীয় স্প্যানটি দেবে গেছে। এর কারণে স্প্যানের উপরের অংশের ব্রীজ অনেক নিচু হয়ে গেছে।
ডুমুরিয়ার ১৪নং মাগুরখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ সানা জানান, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্প্যান দেবে উপরের অংশ নিচু হয়ে গেছে। এছাড়া কাজের মানও সন্তোষজনক নয়। রডে এখনই মরিচা ধরেছে। এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা এলজিইডিকে জানানো হয়েছে।
কিন্তু তারা বিষয়টি অন্যভাবে ব্যাখা দিচ্ছেন। সেই ব্যাখ্যা এলাকার মানুষ মানতে নারাজ। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রকৌশলী প্রলয় কুমার সরকার স্প্যান দেবে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, পিসি গার্ডার ঢালাই দেয়ার সময় ওই স্থানটি নিচু হয়ে গেছে। ওখানে ঢালাই দিয়ে উঁচু ও বাকী কাজ শেষ হলে নিচুর পরিমাণ অনেকটা কমে আসবে। উপকরণ সম্পর্কে বলেন, বিভিন্ন কোম্পানির রড এখানে ব্যবহৃত হয়েছে, যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
তবে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে এএসবিআরএম কোম্পানির রড। এছাড়া অন্যান্য উপকরণের মান ভালো বলে তিনি দাবী করেন। খুলনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ডুমুরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, কোন স্প্যান দেবে যায়নি। ডিজাইনে ওই স্থান নিচু ধরা আছে। এছাড়া উপকরণ সামগ্রীর মানও ভালো।
খুলনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ কামরুজ্জামান জানান, ডিজাইনে স্থানটিতে নিচু ধরা আছে। অন্যদিকে উপকরণ সামগ্রীর মানও খারাপ না। এছাড়া রডের কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। তবে ডিজাইন জটিলতায় কাজ নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। এদিকে ত্রুটিপূর্ণ ব্রীজ তড়িঘড়ি হস্তান্তর ও খুলে দিতে তৎপরতা শুরু করেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর। সমালোচনা এড়াতে তারা কতিপয় কথিত মিডিয়াকর্মীসহ অন্যান্যদের ম্যানেজ করতে মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে।