ভবদহে পানি নিষ্কাশনের নামে মাসে প্রায় ৪ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুতের গচ্ছা!

0
162


হাদিউজ্জামান সুমন, নেহালপুর
পাউবো’র (পানি উন্নয়ন বোর্ড) নেয়া ভবদহে পানি অপসারণের নামে মাসে প্রায় ৪ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ গচ্ছা যাচ্ছে। যশোর-খুলনা জেলার ২৭ বিলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র প্রবাহ পথ ভবদহ স্লুইচগেট। প্রতি মাসে ভবদহ স্লুইচ গেট দিয়ে বিপুল ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যয়ে সেচ পাম্পে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম ভবদহ প্রভাবিত এলাকায় সুফল বয়ে আনেনি। এতে করে বর্তমান বিশেষ প্রকট আকার ধারন করা জ্বালানি সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নে এ প্রকল্প বিদ্যুতের যে ব্যয় হচ্ছে তা অপচয় ছাড়া কিছুই না।

তারপরও পাউবো’র সেচ পাম্পের কর্মতৎপরতা থেমে নেই। বিএডিসি ও পাউবো যৌথভাবে সেচ কার্যক্রম চালালেও এখন পাউবো একাই কাজটি করতে যাচ্ছে। এজন্য এ বছর সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ৫টি পাম্প ঠিকাদারের মাধ্যমে কেনা হয়েছে এবং আরো ৩৫ টি পাম্প, ড্রেজার মেশিন কিনতে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারন করে পানি সম্পাদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যা পরিকল্পনা মন্ত্রলয়ের ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। জানাযায়, ভবদহ এলাকায় ফসল ফলাতে এবং পানিবন্দী মানুষের দূর্ভোগ কমাতে এ উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উপরোন্ত বিল থেকে পানি না সরায় গেলো বছরের তুলনায় এবার ধানের আবাদ আরো কমেছে। আর সেচ পাম্প দিয়ে ভবদহ স্লুইচ গেট দিয়ে পানি নিষ্কাশনে লিকেজ (পানি নদীতে ফিরে আসা) হওয়ায় শুধু চোখে মিলছে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে কিন্তু; কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

যে বিদ্যুৎ খরচ করে সেচ পাম্পে কার্যক্রমের মত অনুন্নয়ন খাতে যে বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে তা দিয়ে বছরে ১৭ হাজার ৯টি পরিবারে (নিন্ম মধ্যে বিত্ত) বিদ্যুৎ ব্যয় সংকুলান হওয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাযায়, গেলো বছরের শুরুতে ভবদহ এলাকায় কৃষি বিপ্লব ঘটাতে গৃহীত এ সেচ পাম্প কার্যক্রম আদৌ ভূমিকা রাখতে পারেনি। চলতি বোরো মৌসুমে গেল বারের তুলনায় কম জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিস সূত্রে জানাগেছে। তারপরও ভবদহ বিল পাড়ের জনমত উপেক্ষা করে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যয় করে পাউবো সেচ পাম্প কার্যক্রম চালিয়েইে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে ভবদহের করাল গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্থ বিল পাড়ের মানুষের সাথে কথা বলে এসব চিত্র উঠে এসছে। ভবদহের পোড় খাওয়া মানুষের দাবি এসব অকার্য্যকর প্রকল্প বাতিল করে অবিলম্বে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-জোয়ার-আধার) চালু করা হোক। এদিকে খোঁজখবর নিয়ে জানাযায়, বিল কপালিয়ায় ফসল ফলাতে ২০২০ সালে মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়া গ্রামবাসি নিজ উদ্যোগে (নিজেদের সংগৃহীত টাকা) সেচ পাম্প কার্যক্রম শুরু করেন।

এরপর পাউবো এই ধারনা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিএডিসি’র (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) কাছে সেচ পাম্প কার্যক্রম গ্রহনের জন্য আবেদন করে। বিএডিসি আবেদনের প্রেক্ষিতে ভবদহ স্লুইচ গেট দিয়ে পানি নিষ্কাশনে ৩০ এইসপি’র (হর্সপাওয়ার) ২০টি পাম্প সরবরাহ করে। সংশ্লিষ্ট পাউবো সুত্রে জানাগেছে, ভবদহ এরাকায় ফসল ফলাতে এবং পানিবন্দী মানুষের দূর্ভোগ লাঘোবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। সেচ কার্যক্রমের শুরুতে শুধু বিদ্যুৎ সংযোগসহ লজেস্টিক সাপোর্টে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা বিদ্যুৎ খরচসহ ব্যবস্থাপনা ব্যয়তো রয়েছে। যপবিস-২ (যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২) এর তৎকালিন ডিজিএম (কারিগরি) আবু হেনা শফিক কামাল জানান, পাউবো’র আবেদনের প্রেক্ষিতে সেচ পাম্প কার্যক্রম চালাতে ২০ টি সংযোগ দেওয়া হয়। পাম্প চালাতে ৭০০ কেভিএ ট্রান্সফরমার বসানো হয়। যার কনস্ট্রাকশন ব্যয় হয় ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ট্রান্সফরমারের জন্য ব্যয় হয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। বছরে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে প্রায় দুই কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে, ভবদহ সেচ পাম্প প্রকল্পে চলতি বছরের শুধু জুন মাসে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হয়েছে। যা বছরে গড়ে ৪২ লাখ ৫৭ হাজার ২৪০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হয়েছে। যার মূল্য ১ কোটি ৭০ লাখ ২৮ হাজার ৯৬০ টাকা। অথচ বর্তমান বিশে^র অনেক দেশ প্রকোট জ¦ালানি সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে।

এ কারনে বিদ্যুৎ’র ব্যয় কমাতে নানা পরিকল্পনা গ্রহন করছে। সংকট উত্তোরনে দেশেও নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টদের মতে দেশের একটি নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে (যে পরিবারে ১টি ফ্রিজ, ১টি এসি, টিভি আছে) এমন পরিবারে প্রতিমাসে গড়ে ১২৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। এ হিসেবে ভবদহে যে পরিমান বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে তা দিয়ে বছরে অনায়েশে প্রায় ১৭ হাজার ৯টি পরিবারে বিদ্যুৎ ব্যয় সংকুলান হওয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্ট পাউবো সূত্রে জানাযায়, ভবদহ তৎসংলগ্ন বিলে ফসল ফলাতে ও পানি বন্দী মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পাউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড) ও বিএডিসি (বাংলাদেশ কষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) যৌথ উদ্যোগে চলতি বছরের শুরুতেই এ কার্যক্রম শুরু করে। বিএডিসির খুলনা বিভাগীয় প্রধান (সেচ বিভাগ) আব্দুল্লাহ আল রশিদ জানান, এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পাউবো’কে বিএডিসি ৩০ এইচপি (হর্সপাওয়ার) পাওয়ারের ২০টি পাম্প সরবরাহ করে। যা রক্ষণাবেক্ষনে বিএডিসির ৮ জন লেবারসহ একজন উপ-প্রকৌশলী সেখানে সার্বক্ষনিক দেখভাল করে থাকেন। কিন্তু লিকেজের দৃষ্টিগোচর হলে তা পাউবোকে অবহিত করা হলেও তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিএডিসি’র তৎকালিন চেয়ারম্যান ডঃ অমিতাভ সরকার, কৃষি সচিব (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত)মোঃ মেজবাহুল ইসলাম সরেজমিন পরিদর্শনে আসলে একই বিষয়টি দৃষ্টি গোচর হয়।

একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর যশোর সার্কিট হাউজে কৃষি মন্ত্রী ডঃ আব্দুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে এক সভায় পাউবোর’ নির্বাহী প্রকৌশলীকে দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও এখন অবধি লিকেজের বিষয়টি রয়েগেছে। ফসল ফলাতে ও পানিবন্দী মানুষের জন্য এ কার্যক্রম গ্রহন করা হলেও কোন সুফল বয়ে আনেনি বলে ভুক্তভোগিদের দাবি। হাটগাছা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক পরমানন্দ মন্ডল, বিবেক মন্ডল, উৎপল বিশ^াসসহ একাধিক ভুক্তভোগি জানান, আকাশ বৃষ্টি না থাকায় পানি কমলেও ফসল আরো কমেছে। মনিরামপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবুল হাসান জানান, ভবদহ প্রভাাবিত উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে (কুলটিয়া, হরিদাসকাঠি, নেহালপুর, মনোহরপুর, খানপুর ও দূর্বাডাঙ্গা) ২০২০-২১ বোরো মৌসুমে ৮হাজার৬২০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়। কিন্তু ২০২১-২২ বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ কমে গিয়ে দাড়ায় ৭ হাজার ৮২৫ হেক্টর জমিতে।

অনুরপভাবে পার্শ্ববর্তী ভয়নগর উপজেলাতেও আবাদ কমেছে। অভয়নগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা গোলাম সামদানি জানান, ভবদহ প্রভাবিত ৫টি ইউনিয়নে (প্রেমবাগ, সুন্দলী, চলিশিয়া, পায়রা ও নওয়াপাড়া পৌরসভা) ২০২০-২১ বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ হয় ৬ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে এবং ২০২১-২২ বোরো মৌসুমে কমে গিয়ে দাড়ায় ৫ হাজার ১৪৯ হেক্টর জমিদে। একইভাবে আমন ধানের আবাদও কমেছে। তিনি বলেন, পাউবো’র সেচ কার্যক্রমে আবাদযোগ্য জমির দৃশ্যত কোন অগ্রগতি হয়নি। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রনজিত বাওয়ালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তাদের দায়ী করে বলেন, মানুষকে জিম্মী করে তারা ভবদহের সমস্যা সমাধানের নামে বড় বড় প্রকল্প তৈরী করে লুটপাট করে চলেছেন।

যে কারণে যুগের পর যুগ ভবদহ পাড়ের মানুষের চোখের পানি পড়লেও ভবদহের মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ইতিমধ্যে সেচ প্রকল্পের নামে প্রকল্প তৈরী করে পানি অপসারণের কাজ চালিয়েছেন। অপরদিকে, লিকেজ দিয়েই আবার সেই পানি প্রবেশ করানো হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হচ্ছে না। জেলা পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম বলেন, সেচ পাম্প দিয়ে পানি অপসারনের কার্যক্রম দ্রুত সুফল আসবে না। উপকারভোগিদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। এজন্য পাউবো নিজস্ব উদ্যোগে ইতোমধ্যে সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ৫টি পাম্প ক্রয়সহ আরো ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫ টি পাম্প ক্রয়ের কার্যক্রম পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়য়াধীন রয়েছে

Comment using Facebook