যশোর অফিস
যশোরে স্কুলের কমিটি গঠন নিয়ে রবিউল ইসলাম নামে এক প্রধান শিক্ষককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ নানাবিধ হুমকি দিয়েছে সদর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মাজহারুল ইসলাম। মুঠোফোনে হুমকি পাওয়ার পর থেকে ওই প্রধান শিক্ষক প্রাণ ভয়ে স্কুলে যাচ্ছেন না।
মুঠোফোনে হুমকি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ায় বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। এ ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম।
কিন্তু পুলিশ এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। গত ২৪ মার্চ দুপুর ২টার দিকে যুবলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম যশোর সদর উপজেলার ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যান। অসুস্থতা জনিত কারণে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন না। এসময় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসেই মাজহারুল তাকে ফোন দেন। এসময় তিনি প্রধান শিক্ষককে নতুন কমিটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে বলেন।
কমিটির বিষয়ে মামলা চলমান রয়েছে জানালে মাজহারুল গালিগালাজসহ নানাবিধ হুমকি দেন। এ সংক্রান্ত অডিও রেকর্ড গতকাল সোমবার ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ৬ মিনিট ৮ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিও মানুষের হাতে হাতে। প্রথমেই যুবলীগনেতা প্রধান শিক্ষককে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করেন।
কথোপকথন নিন্মরূপ: মাজহারুল : স্যার কোথায় আছেন? প্রধান শিক্ষক: আমি অসুস্থ বাসায় আছি। মাজহারুল : কমিটির আবেদন করবেন না আপনি? প্রধান শিক্ষক: এখনো তো করিনি। আমি সুস্থ হয়ে নেই। দেখি কি করা যায়।
মাজহারুল : আমার এমপি সাহেব (যশোর-৩ আসনের সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ) আমারে পাঠিয়েছে। এখন আমি আপনার স্কুলের চেয়ারের সামনে বসে আছি। ফরিদ ভাই (সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহম্মেদ চৌধুরি) কালকে আপনার বাসায় লোক পাঠাতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি বলেছি আপনি অসুস্থ, তাই আসেনি। ফিঙ্গে লিটনের (যশোরের তালিকা ভুক্ত সন্ত্রাসী) গাঁজাখোঁর ইয়াবা খোঁর ছেলে-পেলে যেয়ে আপনার সাথে যদি খারাপ ব্যবহার করে। তা হলে পরবর্তীতে আমার ঘাড়েই আসে। প্রধান শিক্ষক: না… খারাপ ব্যবহার করবে কেন।
মাজহারুল : আপনি আর কথা বলবেন না। আপনার কোন কথা জীবনে আর শুনবো না। আপনি কমিটির দরখাস্ত করবেন না, করবেন.. সেটা গতদিন আপনাকে জানিয়েছি। কালকে এসপির সাথে কথা হলো, হাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কমিটি আপনার আরো তিনমাস পরে মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটি ইতোমধ্যে বের হয়ে গেছে। আপনি কার ক্ষমতায় এই কমিটির আবেদন করছেন না; সেটা আপনাকে বলতে হবে? আর যদি না করেন তা হলেও বলে দিতে হবে আমি এই কমিটির আবেদন করবো না। তার পরে আপনার সাথে বুঝবো পরে এই বিষয়ে।
প্রধান শিক্ষক: তুমি আমার কথা শুনবা না কেন। তোমারে ফোন দিলেই তুমি কেটে দাও শুধু। আমার ফোনটা ধরতে হবে। আর কথাটা শুনতে হবে। মাজহারুল : আচ্ছা বলেন বলেন। প্রধান শিক্ষক: আমি কি আবেদন করবো। যারা মামলা করেছে; তাদের সাথে তো আমার কথা বলা লাগবে না কি? মামলা তুলে দেওয়া লাগবে না? মাজহারুল : ওরা মামলা তুলছে না কেন? উত্তেজিত কন্ঠে আপনি আমারে মামলা বুঝান। আমার এই অল্প বয়সে আমি ৫টা মার্ডার মামলা খেয়েছি। আপনি আইন শেখান। ঐ মামলার কাগজপত্র ৬ মাস পরে সব বাতিল হয়ে যাবে। আপনার কত বড় ক্ষমতা আপনি এমপি সাহেবের কথা শুনছেন না। সব মামলা আপনি করাচ্ছেন। প্রধান শিক্ষক: না আমি করাতে যাবে কেন? মামলা তুলে না নিলে কমিটির আবেদন করা যাবে না তো। তাই সবার সাথে কথা বলতে হবে।
আমি বলবো, তুমি বলবা। মাজহারুল : শুনেন স্যার আমি কারোও সাথে কথা বলতে পারবো না। ২৪ ঘন্টার মধ্যে কার সাথে কথা বলবেন না ; কি বলবেন আপনি জানেন। আপনার কোন মা বাপ (গণমাধ্যমে অপ্রকাশযোগ্য অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ) আছে তাদের সাথে কথা বলেন। ২৪ ঘন্টার মধ্যে কমিটি যদি আবেদন না করেন, তা হলে আপনি যদি যশোর থাকতে পারেন। তার পরে আমি চুরি পরে এই যশোরে ঘুরে বেড়াবো। (গণমাধ্যমে অপ্রকাশযোগ্য অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ) হত্যার হুমকি। আমি আপনার সাথে দুই বছর ভালো ব্যবহার করেছি।
তোমার কিডা ঠেকাই আমি দেখবানে। তোর এতো বড় সাহস তুই কাজী নাবিল আহমেদের ডিও লেটারে মামলা করেছিস। তোর কিডা আছে। তুই আজকের পর থেকে নীলগঞ্জে কিভাবে থাকিস দেখবানে।
তোর লোকজন পুলিশ-র্যাব নিয়ে থাকিস। আমি আসছি। প্রধান শিক্ষক: তুমি কথাবার্তা ভন্দ্র ভাবে বলো। মাজহারুল : আমরা যেভাবে ভন্দ্রতা জনগণকে দেখায়, তত ভন্দ্র কিন্তু আমি না। প্রধান শিক্ষক: তুমি আমার ছাত্র ছিলে, এভাবে বলছো কেন। মাজহারুল : অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলে, এই শহরে এমন কোন অফিসার নেই। আমাকে দেখে নাবিল সাহেবের প্রতিনিধি মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার এগিয়ে দেয়। আর তোর কত বড় সাহস! তুই নাবিল আহমেদের ডিও লেটার উপর এখনো কমিটি আবেদনের দরখাস্ত দিস নে। তোর যে আব্বাগুলো আসে, তাদের বলবি। মাজহারুল এই এই হুমকি দিয়েছে। তাদের আমারে কিছু করে নিতে বলিস।
প্রধান শিক্ষক: কাউকে বলা লাগবে না। আমি সুস্থ হয়ে নেই। তার পরে দেখবানে। মাজহারুল : তা তোর সুস্থ হওয়া লাগবে না। তুই কিভাবে যশোরে থাকিস আমি দেখবানে। তুই যদি যশোরে থাকতে পারিস। আমি আর যশোরে রাজনীতি করবো না। তোর চাকুরি থাকে কিনা দেকিস। তোরে এতোদিন কিছু বলেনি। এতোদিন ভদ্রতা দেখাইছি। তুই আমার স্যার তাই। এখনো অভদ্রতার কিছু দেখিস নে তুই। (অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে) তুই জামায়াত করে এখনো এই জায়গায় আছিস তোর কপাল ভালো বলে ফোন কেটে দেন এই যুবলীগনেতা। এদিকে আজ সকালে ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত। শিক্ষকরা জানান, হুমকি ধামকির ঘটনার পর থেকে তিনি স্কুলে আসলেও বেশিক্ষণ থাকেন না। আজ তিনি স্কুলে আসেননি। ভয়ে আছেন তিনি।
এ বিষয়ে স্কুলের সহকারী শিক্ষক কামরুজ্জামান বাচ্চু বলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। কিন্তু কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে কোন শিক্ষককে এভাবে গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি মোটেই কাম্য নয়। এটা ঠিক হয়নি। সহকারী প্রধান শিক্ষক আক্তারুজ্জামান বলেন, যুবলীগ নেতা মাজহারুল স্কুলে এসে আমাদের সামনেই ফোন করে প্রধান শিক্ষককে শাসান। এরপর থেকে তিনি ভয়ে তটস্থ হয়ে আছেন। ঠিকমত স্কুল করতে পারেছন না।
আমরাও ভীতসন্ত্রস্ত। আমরা স্কুলে পাঠদান করতে আসি। আমাদের সাথে এমন আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়। এদিকে যশোর ডিবি কার্যালয়ে বসে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, যশোর সদর উপজেলার ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আগের কমিটির অগোচরে যুবলীগনেতা মাজহার ও তার সহযোগিতারা এডহক কমিটির সভাপতি হিসাবে মনিরুজ্জামানকে নিযুক্ত করেন। এতে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও অভিভাবকরা ঐ কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনাসহ একজন অভিভাবক হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে এই মামলাটি চলমান রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মাজাহারুল আমাকে কমিটির জন্য আবেদন করতে বলছে।
আমি বলেছি মামলাটি নিষ্পত্তি হলে কমিটির আবেদন করা হবে। কিন্তু তিনি তা মানতে চাইছেন না। যে কারণে তিনি ফোন করে আমাদের হুমকি ধামকি দিয়েছেন।
তিনি আমাকে বলেছেন, আমাকে হত্যা করে ৬নম্বর হত্যার মামলার আসামি হবেন। আমি পরিবার পরিজন নিয়ে ভয়ে দিনাতিপাত করছি। যে কারণে, গত ৩১ ডিসেম্বর যশোর কোতয়ালী মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রিও করেছি। তিনি আরো বলেন, অডিও ভাইরাল হওয়ার পর ডিবি পুলিশের ওসি আমাকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলেছেন। যে কারণে আজ ডিবি অফিসে এসেছি। আমি এ ঘটনায় সুষ্ঠু বিচারের জন্য শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এ বিষয়ে জানতে যুবলীগ নেতা মাজহারুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ৬ মিনিট ৮ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিওটা তার বলে নিশ্চিত করেছেন। তার বক্তব্য চাইলে তিনি বলেন, আমি বাইরে আছি। দেখা করা সম্ভব না।
ফোনে বক্তব্য চাইলে তিনি বলেন, আমি আপনাকে একটু পরে ফোন দিচ্ছি বলে ফোনটি কেটে দেন। এ বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে যশোর পুলিশের মুখপাত্র ডিবি পুলিশের ওসি রুপণ কুমার সরকার বলেন, আমি অডিওটা অনেকবার শুনেছি। এত বাজে ল্যাঙ্গুয়েজ। শোনা যায় না।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে মিডিয়ার সামনে বক্তব্য না দেয়ার ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা রয়েছে। এব্যাপারে যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহম্মেদ চৌধুরি জানান, ভাইরাল হওয়া অডিও’র যে অংশে আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে তার সাথে আমার দূরতম কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।